ইসলামী আকিদার পরিচয়...বিস্তারিত
আকিদার শাব্দিক পরিচয় : আকিদা শব্দটি একটি আরবি শব্দ। ‘আক্দুন’ মূলধাতু থেকে গৃহীত বা উৎপন্ন। এর শাব্দিক অর্থ বন্ধন করা, গিরা দেওয়া, চুক্তি করা বা শক্ত হওয়া ইত্যাদি। আরবী ভাষাবিদ ইবনু ফারিস এই শব্দের অর্থ বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, আইন, ক্বাফ ও দাল- ধাতুটির মূল অর্থ একটিই। আর তা হলো- দৃঢ়করণ, দৃঢ়ভাবে বন্ধন, ধারণ বা নির্ভর করা। শব্দটি যত অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে তা সবই এই অর্থ থেকে গৃহীত। [ইবনু আবী শাইবা, আবু বাকর আব্দুল্লাহ ইবনু মুহাম্মাদ (২৩৫ হি), আল-মুসান্নাফ (রিয়াদ, সৌদি আরব, মাকতাবাতুর রুশদ, ১ম প্রকাশ, ১৪০৯ হি)]
এছাড়া আকিদার শাব্দিক বিশ্লেষণ করতে গিয়ে ইসলামি আকিদা বিষয়ক বিখ্যা গ্রন্থে এইভাবে আলোচনা তুলে ধরা হয়েছে…
كلمة “عقيدة” مأخوذة من العقد والربط والشدّ بقوة، ومنه الإحكام والإبرام، والتماسك والمراصة. # بيان عقيدة أهل السنة والجماعة ولزوم اتباعها 1/4
আকিদা শব্দটি আক্দুন মূলধাতু থেকে গৃহীত। যার অর্থ হচ্ছে, সূদৃঢ়করণ, মজবুত করে বাঁধা। [বায়ানু আকিদাতু আহলিস সুন্নাহ ওয়াল জামাআহ, ১/৪]
আকিদার পারিভাষিক পরিচয় : আকিদার পারিভাষিক সংজ্ঞা বর্ণনা করতে গিয়ে আহমদ ইবনু মুহাম্মাদ আল-ফাইউমী (রহ.) তার রচিত আল মিসবাহুল মুনীর গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, মানুষ ধর্ম হিসেবে যা গ্রহণ করে তাকেই আকিদা বলা হয়।
ইসলামি পরিভাষায় আকিদা বলা হয়- নির্দিষ্ট কিছু বিষয়ের ওপর বিশ্বাস স্থাপন করা এবং সেই বিশ্বাসের পরিপালন করা। সুতরাং ইসলামি আকিদা বলতে এমন কিছু বিষয়ের ওপর বিশ্বাস করাকে বুঝায় যার কারণে ঐ ব্যক্তিকে মুমিন বিবেচিত করা হয়। [ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর রচিত কুরআন-সুন্নাহর আলোকে ইসলামী আকিদা]
এছাড়া ইসলামি আকিদার সংজ্ঞা বর্ণনা করতে গিয়ে বলা হয়েছে,
العقيدة الإسلامية: هي الإيمان الجازم بالله، وملائكته، وكتبه، ورسله، واليوم الآخر، والقدر خيره وشره، وبكل ما جاء في القرآن الكريم، والسنة الصحيحة من أصول الدين، وأموره، وأخباره. # رسائل الشيخ محمد بن إبراهيم في العقيدة 7/2
শরীয়তের পরিভাষায় ইসলামি আকিদা হচ্ছে, মহান আল্লাহ তাআলা, তাঁর ফেরেশতাকুল, তাঁর কিতাবসমূহ, তাঁর রাসূলগণ, শেস দিবস তথা মৃত্যু পরবর্তী যাবতীয় বিষয় ও তাকদীরের ভাল-মন্দের প্রতি এবং আল-কুরআনুল হাকিম ও সহিহ হাদিসে উল্লেখিত দীনের সকল মৌলিক বিষয়ের প্রতি অন্তরের সুদৃঢ় মজবুত ও বিশুদ্ধ বিশ্বাসের নাম আকিদা। [রিসালাতুম শাইখ মুহাম্মাদ ইবন ইবরাহীম ফিল আকিদা, ৭/২]
আকিদার শব্দের পারিভাষিক প্রচলন-ইতিহাস : ‘ধর্মবিশ্বাস’ বুঝাতে আকিদা শব্দের ব্যবহার পরবর্তী যুগে ব্যাপক হলেও প্রাচীন আরবী ভাষার এর ব্যবহার খুব বেশি দেখতে পাওয়া যায় না। ‘বিশ্বাস’ বা ‘ধর্মবিশ্বাস’ অর্থে ‘আকিদা’ ও ‘ইতিকাদ’ শব্দের ব্যবহার কোরআন ও হাদিসেও দেখা যায় না। রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর যুগে বা তাঁর পূর্বের যুগে আরবি ভাষায় ‘বিশ্বাস’ অর্থে বা অন্য কোনো অর্থে ‘আকিদা’ শব্দের ব্যবহার ছিল বলে জানা যায় না। তবে ‘দৃঢ় হওয়া’ বা ‘জমাট হওয়া’ অর্থে ‘ইতিকাদ’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে।
এছাড়া অন্তরের বিশ্বাস অর্থেও ‘ইতিকাদ’ শব্দটির প্রচলন ছিল। প্রসিদ্ধ ভাষাবিদ ইসমাঈল ইবনু হাম্মাদ জাওহারি (৩৯৩ হি) বলেন, “সম্পত্তি বা সম্পদ ‘ইতিকাদ’ করেছে, অর্থাৎ তা অর্জন করেছে বা সঞ্চয় করেছে। কোনো কিছু ‘ইতিকাদ’ হয়েছে অর্থ শক্ত, কঠিন বা জমাটবদ্ধ হয়েছে। অন্তর দিয়ে অমুক বিষয় ইতিকাদ করেছে। তার কোনো মাকুদ নেই অর্থাৎ তার মতামতের স্থিরিতা বা দৃঢ়তা নেই।” [আহমদ ইবনু হাম্বাল (২৪১হি), আল-মুসনাদ, কাইরো, মিশর, মুআসসাসাতু কুরতুবাহ ও দারুল মাআরিফ, ১৯৫]
কোরআন-হাদিসে কোথাও আকিদা শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে বলে জানা যায় না। ‘ইতিকাদ’ শব্দটি দু একটি হাদিসে ব্যবহৃত হয়েছে, তবে ‘বিশ্বাস’ অর্থে নয়, বরং সম্পদ, পতাকা ইত্যাদি দ্রব্য দৃঢ়ভাবে ধারণ করা, বন্ধন করা বা গ্রহণ করা অর্থে। দ্বিতীয় শতাব্দীর কোনো কোনো ইমাম ও আলিমের কথায় ‘ইতিকাদ’ বা ‘আকিদা’শব্দ সুদৃঢ় ধর্ম বিশ্বাস অর্থে ব ̈বহৃত হয়েছে বলে দেখা যায়। পরবর্তী শতাব্দীগুলিতে ‘আকিদা’ শব্দের ব ̈বহার ব্যপকতা লাভ করে। চতুর্থ-পঞ্চম শতকে লিখিত প্রাচীন আরবি অভিধানগুলিতে ‘আকিদা’ শব্দটি উল্লেখ করা হয়েছে বলে দেখতে পাইনি। [ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর রচিত কুরআন-সুন্নাহর আলোকে ইসলামী আকিদা]
ইসলামের মৌলিক আকিদা বা ইমানের স্তম্ভসমূহ :‘মুমিন’ বা ঈমানদার হিসেবে গণ্য হতে একজন মানুষকে কী কী বিষয়ে বিশ্বাস স্থাপন করতে হবে তা মহান আল্লাহ তাআলা কুরআনুল কারীমের বিভিন্ন স্থানে উল্লেখ করেছেন। এ ছাড়া রাসূলের (সা.) সুন্নাহ বা হাদিসেও বিষয়টি ব্যাখ্যা করা হয়েছে। ইসলামের পরিভাষায় এগুলিকে ‘আরকানুল ঈমান’ বা ঈমানের স্তম্ভ বলা হয়।
মহান আল্লাহ বলেন, ‘পূর্ব এবং পশ্চিম দিকে তোমাদের মুখ ফেরানোর মধ্যে কোনো পুণ্য নেই। কিন্তু পুণ্য তার যে বিশ্বাস স্থাপন করেছে আল্লাহর প্রতি, পরকালের প্রতি, ফেরেশতাগণের প্রতি, কিতাবসমূহে ও নবীগণের প্রতি এবং ধন-সম্পদের প্রতি মনের টান থাকা সত্ত্বেও আত্মীয়-স্বজন, পিতৃহীন-অনাথ, অভাবগ্রস্ত, পথিক, সাহায্য প্রার্থনাকারীগণকে ও দাসমুক্তির জন্য অর্থ ব্যয় করে, এবং সালাত কায়েম করে, যাকাত প্রদান করে, প্রতিশ্রুতি দিলে তা পূর্ণ করে আর অর্থ-সংকটে, দুঃখ-ক্লেশে ও সংগ্রাম-সংকটে ধৈর্য্য ধারণ করে। এরাই প্রকৃত সত্যপরায়ণ এবং এরাই মুত্তাকী।’ [সূরাহ বাকারা: ১৭৭]
এখানে আল্লাহ তাআলা জানিয়েছেন যে, শুধু আনুষ্ঠানিকতার নাম ইসলাম নয়, প্রাণহীন আনুষ্ঠানিকতায় কোনো পুণ্য নেই। ইসলাম হলো বিশ্বাস ও কর্মের সমন্বয়। এখানে আল্লাহ মুমিনের বিশ্বাসের মৌলিক পাঁচটি বিষয় এবং তার মৌলিক কর্ম ও চরিত্রের বর্ণনা দিয়েছেন।
অন্যত্র আল্লাহ মহান বলেন, ‘রাসূল তাঁর প্রতি তাঁর প্রতিপালকের পক্ষ থেকে যা অবতীর্ণ করা হয়েছে তাতে ঈমান এনেছেন এবং মুমিনগণও। তারা সকলেই আল্লাহর প্রতি, তাঁর ফেরেশতাগণের প্রতি, তাঁর কিতাবসমূহে এবং তাঁর রাসূলগণের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেছেন। আমরা তাঁর রাসূলগণের মধ্যে কোনোরূপ পার্থক্য করি না।’ [সূরাহ বাকারা: ২৮৫]
এখানে ঈমানের স্তম্ভগুলির মধ্য থেকে ৪টি বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে। অন্য আয়াতে ৫টি বিষয়ের উল্লেখ করে আল্লাহ বলেন, ‘হে মুমিনগণ, তোমরা আল্লাহর ওপর, তাঁর রাসূলের ওপর আর যে গ্রন্থ তাঁর রাসূলের প্রতি অবতীর্ণ করেছেন তার ওপর এবং যেসব গ্রন্থ তিনি পূর্বে অবতীর্ণ করেছেন তাতে বিশ্বাস স্থাপন করো। অতঃপর কেউ আল্লাহ, তাঁর ফেরেশতাগণ, তাঁর গ্রন্থসমূহ, তাঁর রাসূলগণ এবং আখিরাতকে অবিশ্বাস করলে সে ভীষণভাবে পথভ্রষ্ট হয়ে পড়বে।’ [সূরাহ নিসা: ১৩৬]
এভাবে কুরআন কারীমের বিভিন্ন স্থানে উপরের বিষয়গুলি একত্রে বা পৃথকভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। বিভিন্ন হাদীসেও ঈমানের রুকন বা স্তম্ভগুলি উল্লেখ করা হয়েছে। ঈমানের পরিচয় দিয়ে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: ‘(ঈমান এই যে,) তুমি বিশ্বাস করবে আল্লাহয়, তাঁর ফেরেশতাগণে, তাঁর কিতাবসমূহে, তাঁর সাক্ষাতে, তাঁর রাসূলগণে; তুমি বিশ্বাস করবে শেষ পুনরুত্থানে এবং তুমি বিশ্বাস করবে তাকদীর বা নির্ধারিত বিষয়সমূহে।’ [সহীহুল বুখারী: ১/২৭, ৪/১৭৩৩; সহীহ মুসলিম: ১/৩৯, ৪০, ৪৭]
হজরত উমার ইবনুল খাত্তাব (রা.) অন্য এক হাদীসে। তিনি বলেন, একদিন আমরা রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নিকট বসে ছিলাম। এমতাবস্থায় এক ব্যক্তি সেখানে আসলেন। তাঁর পোশাক-পরিচ্ছদ অত্যন্ত ধবধবে সাদা এবং মাথার চুলগুলো অত্যন্ত পরিপাটি ও কাল।..তিনি রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে ঈমান সম্পর্কে প্রশ্ন করে বলেন, ঈমান কী তা আমাকে বলুন। উত্তরে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘ঈমান হলো এই যে, তুমি বিশ্বাস করবে আল্লাহর প্রতি, তাঁর ফেরেশতাগণের প্রতি, তাঁর গ্রন্থসমূহে, তাঁর রাসূলগণে ও শেষ দিবসে (আখিরাতে) এবং বিশ্বাস করবে আল্লাহর নির্ধারিত তাকদীরের (ভাগ্যের) ভাল ও মন্দে।’ [সহীহ মুসলিম: ১/৩৫-৩৬]
এভাবে বিভিন্ন আয়াত ও হাদীসের আলোকে আমরা জানতে পারি যে, ইসলামের মৌল বিশ্বাস বা ‘আল-আকীদাহ আল ইসলামিয়্যাহ’-র সাতটি মৌলিক স্তম্ভ রয়েছে—
১. আল্লাহর ওপর ঈমান। ২. আল্লাহর ফেরেশতাগণের প্রতি ঈমান। ৩. আল্লাহর নাযিল করা কিতাবসমূহের প্রতি ঈমান। ৪. আল্লাহর রাসূলগণের ওপর ঈমান। ৫. পুনরুত্থানের প্রতি ইমান। ৬. কিয়ামত, পরকাল বা আখিরাতের ওপর ঈমান এবং৭. তাকদীর বা আল্লাহর নির্ধারণ ও সিদ্ধান্তের ওপর ঈমান। এ বিষয়গুলোকে আরকানুল ঈমান, অর্থাৎ ঈমানের স্তম্ভসমূহ, ভিত্তিসমূহ বা মূলনীতিসমূহ বলা হয়।
No comments