কুরআন ও হাদিসের আলোকে রোজার ফজিলত ও গুরুত্ব


রমজানের রোজা হচ্ছে ইবাদতের মাঝে ইসলামের পাঁচ স্তম্ভের অন্যতম। ঈমান, সালাত ও জাকাতের পরই রোজার স্থান। রোজার আরবি শব্দ সাওম, যার আভিধানিক অর্থ বিরত থাকা। সাওম হলো, প্রত্যেক সন্তান, বালেগ মুসলমান নর-নারীকে সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত রোজার নিয়তে পনাহার, স্ত্রী সহবাস ও রোজা ভঙ্গকারী সকল কাজ থেকে বিরত থাকা।
সুতরাং রমজান মাসের চাঁদ উদিত হলেই প্রত্যেক সুস্থ, প্রাপ্ত বয়স্ক পুরুষ এবং হায়েজ নেফাজমুক্ত (মাসিক ও সন্তান হওয়ার পরে রক্তস্রাব) প্রাপ্ত বয়স্কা নারীর ওপর রোজা রাখা ফরজ।
এ সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ, তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে যেমন ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর, যেন ‍তোমরা মুত্তাকি হতে পার।’ (সূরা বাকারা-১৮৩)
অন্য আয়াতে আল্লাহ পাক বলেন, ‘সুতরাং তোমাদের মাঝে যে ব্যক্তিই এ মাস পাবে সে যেন রোজা রাখে। (সূরা বাকারা, আয়াত ১৮৫)।
সুতরাং রমজান মাসে সাওম পালন করা ফরজে আইন।
কোনো মুসলমান যদি রমজান মাসের একটি রোজাও ইচ্ছাকৃতভাবে পরিত্যাগ করে, তাহলে সে বড় গুনাহগার ও জঘণ্য অপরাধী হিসেবে গণ্য হবে। দ্বীনের মৌলিক বিধান লঙ্ঘনকারী ও ঈমান-ইসলামের খেয়ানতকারী হিসেবে পরিগণিত হবে।
ইচ্ছাকৃতভাবে রোজা ত্যাগকারী ও ভঙ্গকারীদের জন্য হাদিস শরিফে কঠিন শাস্তির কথা রয়েছে।
হযরত আবু উমামা (রাঃ) বলেন, ‘আমি রাসুলুল্লাহকে (সাঃ) বলতে শুনেছি, তিনি বলেন,, আমি ঘুমিয়ে ছিলাম। স্বপ্নে দেখলাম আমার কাছে দুইজন ব্যক্তি আগমন করলেন। তারা বাহু ধরে আমাকে এক দূর্গম পাহাড়ে নিয়ে এল। এরপর আমাকে বললেন, আপনি পাহাড়ের উপরে উঠুন। আমি বললাম, আমি উঠতে পারবো না। তারা বললো, আমরা আপনাকে সাহায্য করবো। আমি উপরে উঠলাম। যখন আমি পাহাড়ের সমতল ভূমিতে পৌঁছালাম, হঠাৎ ভয়ংকর আওয়াজ শুনতে পেলাম। আমি তাদের জিজ্ঞেস করলাম, এটা কিসের আওয়াজ? তারা বললেন, এটা জাহান্নামীদের আর্তনাদ। তারা আমাকে নিয়ে এগিযে চলল। হঠাৎ কিছুলোক দেখতে পেলাম, তাদের মাংসপেশী দ্বারা ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে এবং তাদের মুখের দুই প্রান্ত ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে। তা থেকে তাদের রক্ত ঝরছে। আমি বললাম, এরা কারা? তারা বলল, যারা ইফতারের পূর্বেই রোজা ভেঙ্গে ফেলতো তারা এরা।
১. সহীহ ইবনে খুযাইমা ১৯৮৬
২. সহীহ ইমনে হিব্বান ৭৪৪৮
৩. মুস্তাদরাকে হাকিম ১৬০৯
রমজান মাসের একদিন রোজা না রাখলে মানুষ যে শুধু গুনাহগার হবেন তা নয়, বরং এ রোজার পরিবর্তে সারা জীবন রোজা রাখলেও এর যথার্থ ক্ষতিপূরণ আদায় হবে না।
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাঃ বলেন, যে ব্যক্তি অসুস্থতা ও সফর ছাড়া ইচ্ছাকৃতভাবে রমজানে একটি রোজাও ভঙ্গ করে, তিনি আজীবন রোজ রাখলেও এ রোজার হক আদায় হবে না।
১. মুসান্নাফে ইবনে আবি শাইরা ৯৮৯৩
২. মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক ৭৪৭৬
৩. সহীহ বুখারি ৪/১৫০
হাদিসের আলোকে রোজার কিছু ফজিলত

রোজার প্রতিদান আল্লাহপাক নিজেইদেবেন এবং বিনা হিসাবে
প্রত্যেক নেক আমলের নির্ধারিত সওয়াব ও প্রতিদান রয়েছে যার মাধ্যমে আল্লাহ পাক আমলকারীকে পুরস্কৃত করবেন। কিন্তু রোজার বিষয়টি সম্পূর্ণ আলাদা। কারণ রোজার বিষয়ে আছে আল্লাহর পক্ষ থেকে এক অনন্য ঘোষণা।
হযরত আবু হুরায়রা রাঃ থেকে বর্ণিত রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, মানুষের প্রতিটি আমলের প্রতিদান বৃদ্ধি করা হয়। একটি নেকির সওয়াব দশগুণ থেকে সাতশ’ গুণ পর্যন্ত হতে পারে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, কিন্তু রোজার বিষয়টা আলাদা। কেননা তা আমার জন্য এবং আমি নিজেই এর বিনিময় প্রদান করবো। বান্দা একমাত্র আমার জন্য নিজের প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণ করেছে এবং পানাহার পরিত্যাগ করেছে।
১. সহীহ মুসলিম ১১৫১
২. মুসনাদে আহমাদ ৯৭১৪

 আল্লাহ তায়ালা রোজাদারদের কিয়ামতেরদিন পানি পান করাবেন
হযরত আবু মুসা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, আল্লাহ তায়ালা নিজের উপর অবধারিত করে দিয়েছেন যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য গ্রীষ্মকালে (রোজা রাখার কারণে) পিপাসার্ত থেকেছে, তিনি তাকে তৃষ্ণার দিন (কিয়ামতের দিন) পানি পান করাবেন।

 রোজা জান্নাত লাভে পথ
হযরত আবু ওমামা রাঃ হতে বর্ণিত, আমি রাসুলুল্লাহ’র (সাঃ) দরবারে গিয়ে বললাম, ইয়া রাসুলুল্লাহ, আমাকে এমন একটি আমল বলে দিন যার দ্বারা আমি জান্নাতে প্রবেশ করতে পারি।
রাসুলুল্লাহ বললেন, তুমি রোজা রাখ। কেননা এর সমতুল্য কিছু নেই। আমি পুনরায় জিজ্ঞেস করলাম। রাসুল (সাঃ) জবাব দিলেন, তুমি রোজা রাখ। (মুসনাদে আহমাদ ২২১৪৯)

 রোজাদার বেহেস্তে প্রবেশ করবে রাইয়াননামক বিশেষ দরজা দিয়ে
হযরত সাহল ইবনে সা’দ রাঃ হতে বর্ণিত, নবী (সাঃ) বলেছেন, জান্নাতে একটি দরজা আছে যার নাম রাইয়ান। কিয়ামতের দিন এ দরজা দিয়ে কেবল রোজাদারগণ প্রবেশ করবেন। অন্য কেউ প্রবেশ করতে পারবে না। ঘোষণা করা হবে কোথায় সেই সৌভাগ্যবান রোজাদারগণ? তখন তারা উঠে দাঁড়াবে। তারা ব্যতীত কেউ এ দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে পারবে না। অতঃপর রোজাদারগণ যখন প্রবেশ করবে, তখন তা বন্ধ করে দেওয়া হবে। ফলে কেউ এ দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে পারবে না।
১. সহীহ মুসলিম ১১৫২
২. মুসনাদে আহমাদ ২২৮১৮

. রোজা জাহান্নাম থেকে রক্ষাকারী ঢাল দুর্গ
হযরত জাবির (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, রোজা হলো (জাহান্নাম থেকে পরিত্রাণ লাভের) ঢাল ও সুরক্ষিত দূর্গ। (মুসনাদে আহমাদ ৯২২৫)

 রোজ কিয়ামতের দিন সুপারিশ করবে
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (রাঃ) বর্ণিত, রাসুল (সাঃ) বলেছেন, রোজা ও কুরআন কিয়ামতের দিন বান্দার জন্য সুপারিশ করবে। রোজা বলবে, হে রব, আমি তাকে খাদ্য ও যৌন সম্ভোগ থেকে বিরত রেখেছি। অতএব তার ব্যাপারে আমার সুপারিশ গ্রহণ করুন। কুরআন বলবে, আমি তাকে রাতের ঘুম থেকে বিরত রেখেছি। অতএব তার ব্যাপারে আমার সুপারিশ গ্রহণ করুন।
রাসুল (সাঃ) বলেন, অতঃপর তাদের উভয়ের সুপারিশ গ্রহণ করা হবে। (মুসনাদে আহমাদ ৬৬২৬)

 রোজাদারের সকল গুনাহ মাফ হয়ে যায়
হযরত আবু হুরায়রা রাঃ বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে সওয়াবের আশায় রমজান মাসের রোজা রাখে তার পূর্ববর্তী সকল গুনাহসমূহ মাফ করে দেওয়া হয়। (সহীহ বুখারি ২০১৪)

 রেজাদারের মুখের গন্ধ মিশকের চেয়েওসুগন্ধিযুক্ত
হযরত আবু হুরায়রা রাঃ বর্ণিত, রাসুল (সাঃ) বলেছেন, শপথ সেই সত্ত্বার যার হাতে রয়েছে মুহাম্মদের প্রাণ, রোজাদারের মুখের গন্ধ আল্লাহতায়ালার কাছে মিশকের সুগন্ধির চেয়েও অধিক সুগন্ধিময়। (সহীহ বুখারি ১৯০৪)

 রোজাদারের দুটি আনন্দের মুহূর্ত
হযরত আবু হুরায়রা রাঃ বর্ণিত, নবীজী (সাঃ) বলেছেন, রোজাদারের জন্য দুটি আনন্দের মুহূর্ত রয়েছে। যখন সে আনন্দিত হবে-
এক. ইফতারের সময়। তখন সে ইফতারের কারণে আনন্দ পায়।
দুই. যখন সে তার রবের সঙ্গে সাক্ষাত লাভ করবে তখন তার আনন্দ হবে।
অপর এক বর্ণনায় এসেছে, যখন তার প্রতিপালক রোজার পুরস্কার দিবেন। (সহীহ মুসলিম ১১৫১)

১০
 রোজাদারের দুয়া কবুল হয়
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (রাঃ) হতে বর্ণিত, নবী (সাঃ) ইরশাদ করেন, ইফতারের সময় রোজাদার যখন দুয়া করেন তখন তার দুয়া ফিরিয়ে দেওয়া হয় না। (অর্থাৎ দুয়া কুবল কর হয়) (সুনানে ইবনে মাজাই ১৭৫৩)
আরও অসংখ সহীহ হাদিসে রমজানের গুরুত্ব ও ফজিলত বর্ণনা করা হয়েছে। রমজান হলো ইবাদতের মৌসুম। বলা যায়, বসন্ত এসেছে, কেউ কি আছে এতে আমল করবে?
আল্লাহ আমাদের সকলকে হাদিস ও সুন্নাহ অনুযায়ী আমল করার তৌফিক দান করুক। আমিন ইয়া রাব্বুল আলামিন।

No comments

Powered by Blogger.